সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ ছিলো একুশ বছর। আর এই দীর্ঘ সময়ে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন, এরশাদের সামরিক শাসন এবং খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে দেয়নি; বরং তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সহযোগিতা করেছে।
সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় হত্যাকারীদের বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে চাকুরি এবং পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছিলো। দেশের বিপক্ষে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এরশাদ সরকারের আমলেও খুনিদের পদোন্নতি অব্যাহত থাকে। এমনকি খুনিদের কেউ কেউ দেশে ফিরে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ জাতীয় সংসদের সদস্যও হয়েছে; খালেদা জিয়ার আমলেও এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে।
১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে নিম্নোক্ত ১২জনকে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দেওয়া হয়েছিলো:
১. শরিফুল হক ডালিম, চীনের প্রথম সচিব
২. আজিজ পাশা, আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব
৩. মহিউদ্দিন আহমেদ, আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব
৪. বজলুল হুদা, পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব
৫. শাহরিয়ার রশীদ, ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব
৬. রাশেদ চৌধুরী, সৌদি আরবে দ্বিতীয়
৭. নূর চৌধুরী, ইরানে দ্বিতীয় সচিব
৮. শরিফুল হোসেন, কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব
৯. কিসমত হাশেম, আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব
১০. খায়রুজ্জামান, মিশরে তৃতীয় সচিব
১১. নাজমুল হোসেন আনসার, কানাডায় তৃতীয় সচিব
১২. আবদুল সাত্তার, সেনেগালে তৃতীয় সচিব
উল্লেখিত খুনিদের নিয়োগপত্র ঢাকা থেকে লিবিয়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। এর আগে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে তাদের সঙ্গে আলোচনা-সমঝোতার জন্য তৎকালীন মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু লিবিয়ায় গিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ফরেন সার্ভিস ক্যাডারে অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া হয়। তবে উল্লেখিত ১২জন সেনাকর্মকর্তা ফরেন সার্ভিসে যোগ দিতে রাজি হলেও প্রধান দুই হোতা ফারুক ও রশীদ জিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করে চাকুরি না নিয়ে ব্যবসা করার মনস্থির করেন, জিয়াউর রহমান তাদের ব্যবসার মূলধন হিসেবে আর্থিক সহযোগিতা করে। ফারুক ও রশীদ লিবিয়া সরকারের বিশেষ অনুকম্পা লাভ করে।
এরশাদের শাসনামলেও এই খুনিদের প্রতি বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়। এদের অনেকেই এরশাদ আমলেই পদোন্নতি পেয়ে রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত হয়েছে। পদোন্নতি পেয়ে মেজর নূর ব্রাজিলে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। শরিফুল হক ডালিমকে কানাডায় নিয়োগ দেওয়ার পূর্বে সমাজতান্ত্রিক দেশ পোল্যান্ডে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু পোল্যান্ডের জেরুজালেস্কি সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। নিজ দেশে বর্তমানে নিঃসঙ্গ এবং একাকী জীবন জীবনযাপন করলেও আশির দশকে দোর্দণ্ড প্রভাবশালী এই পোলিশ একনায়কের সিদ্ধান্তকে বাঙালি আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
খুনিদের স্বার্থরক্ষার জন্য জিয়া-এরশাদ-খালেদা সরকার রীতিমতো প্রতিযোগিতায় মত্ত থেকেছে। বেনজির ভুট্টো সরকার পাকিস্তানে খুনি মহিউদ্দিন আহমেদকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেও সৌদি সরকার এই খুনিকে সৌদি আরবে বাংলাদেশের মিশন উপ-প্রধান হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিসমত হাশেম এবং নাজমুল হোসেন আনসার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকুরি ছেড়ে কানাডার নাগরিকত্ব নিয়েছিলো।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রথম আমলে (১৯৯৬-২০০১) খায়রুজ্জামান জেল খাটলেও বিএনপি-জামাত জোট আমলে জেল থেকে বের হয়ে মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই খায়রুজ্জামান পলাতক। এই খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন সময়েই মালয়েশিয়া বাঙালিদের জন্য কলিং ভিসা বন্ধ করে দেয়, এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে হাজার হাজার বাঙালি অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে শ্রম অসন্তোষের পেছনে এই খুনি সেনাকর্মকর্তার হাত রয়েছে। এছাড়া খুনি আজিজ পাশার মৃত্যুর পর তার পরিবারকে যাবতীয় সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে বিএনপি-জামাত জোট সরকার।
যে খুনিদের জিয়া-এরশাদ-খালেদা প্রতিপালন করেছে পরম মমতায়, সেই খুনিদেরই একটি অংশ ১৯৮০ সালের ১৭ জুন সেনানিবাসের অভ্যন্তরে একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালায়; সেই সময়ে মেজর ডালিম-নূর-হুদা-আজিজ পাশাদের গ্রেফতার করা হয়েছিলো। পরে আবার মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উগ্র বামপন্থিরা কখনোই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার ঘটনা মেনে নিতে পারেনি। Sranly Wolpert-এর ‘Zulfi Bhutto of Pakistan’ বইতে তথাকথিত কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী ও বামপন্থি বিপ্লবী আবদুল হক-এর একটি চিঠি মুদ্রিত হয়েছিলো, ওই চিঠিতে আবদুল হক এবং তথাকথিত ভাষা সংগ্রামী আবদুল মতিন বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করে পুনরায় পাকিস্তান কায়েমের জন্য ভুট্টোর কাছে অস্ত্র ও অর্থের যোগান চেয়েছিলো।
মেহনাজ এবং বিগ্রেডিয়ার বারি’র বদৌলতে সরকারের বিশেষ সংস্থার আসল চরিত্র উন্মোচিত হলেও, এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা ১৯৮৩ সালে আরো একবার উন্মোচিত হয়েছিলো। আশির দশকে খুনি ফারুক-রশীদ ‘মুক্তির পথ’ নামে একটি চটি বই লিখেছিলো, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে বিনে পয়সায় সেই বই বিতরণ করা হয়। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আদর্শিক কায়দায় পুনর্বাসিত করার অপচেষ্টা নিয়েছিলো রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। এরপরের ইতিহাস আরো করুণ।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে খুনি ফারুক রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলো। বলতে গেলে সেটাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের প্রথম এক্সপোজার। বস্তুত আওয়ামী লীগকে দমন করার জন্য এই অপশক্তিকে রাজনীতিতে সক্রিয় করা হয়েছিলো। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে খুনি বজলুল হুদাকে মেহেরপুর থেকে এমপি বানানো হয়েছিলো। এই কলঙ্ক বাংলাদেশের। ১৯৯৬ সালের সাদেক আলী নির্বাচনে খুনি রশীদকে বিরোধী দলীয় নেতা মনোনীত করা হয়েছিলো। আর এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত লাল-সবুজের বাংলাদেশকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিলো স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র।
(সংগৃহীত)
সুমন ঘোষ
২০ জুন,ময়মনসিংহ