হোসেনপুর (কিশোরগঞ্জ) সংবাদদাতা :
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ ঐতিহ্যের চিরচেনা ঢেঁকি শিল্প। বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতির ভিড়ে হারিয়ে গেছে ঢেঁকির পুরোনো ঐতিহ্য। কালের পরিক্রমায় ঢেঁকি এখন শুধু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতিই বহন করে চলেছে। তবে দিন দিন এ ঢেঁকি শিল্প হারিয়ে গেলেও নিপুণ কারিগরের তৈরি কাঠের যন্ত্রটিকে টিকিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকরি উদ্যোগ নেই বললেই চলে। তাই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহি ঢেঁকি আগের মত এখন আর চোখে পড়ে না।
তবে উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চল এলাকায় দু-একটি বাড়িতে পিঠা তৈরির অন্যতম অনুষঙ্গ ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি এখনো স্মৃতি হিসেবে ধরে রেখেছেন বলে জানান মোঃ শাহজাহান নামের এক কাঠমিস্ত্রি।তবে দীর্ঘদিন পর চরাঞ্চলে এসব ঢেঁকি ব্যবহার হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহকালে উপজেলার স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ হোসেনপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক এম.এ হাকিম জানান, তৎকালীন বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমল থেকেই ঢেঁকি ছিল এ গ্রামীণ জনপদের চাল ও চালের গুঁড়া তৈরীর একমাত্র কাঠের সরল যন্ত্র। প্রতি বছর অগ্রহায়ন-পৌষ মাসে কৃষক ধান কাটার পর কৃষাণীদের ঘরে ঘরে ধান থেকে চাল ও চালের গুঁড়া তৈরির ধুম পরে যেতো। সে সময় কৃষাণিরা দাওয়াত করে নিকট আত্বীয় স্বজনদের জামাই আদরে আপ্যায়ন করতেন ঢেঁকি ছাঁটা চালের গুঁড়ার তৈরি রকমারি স্বাদের পিঠা, পুলি, ফিরনী, পায়েস ইত্যাদি দিয়ে। এছাড়াও অন্যান্য উৎসবে, বিয়ে, ঈদ ও পূঁজা পার্বণের জন্য ওই ঢেঁকিছাটা চালের গুঁড়া অধিক পরিমাণে তৈরী করে কৃষাণিরা মটকায় রেখে দিতেন।
অনেকেই আবার আটা তৈরি করতেও ব্যবহার করতেন ঢেঁকি। অন্যদিকে কেউ কেউ আবার ঢেঁকি ছাটা আউশ ধানের চালের পান্তা ভাত খেতেও খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে এ সবকিছুই এখন স্মৃতির গহীনে হারিয়ে গেছে। উপজেলার সাহেবের চর গ্রামের কুঠির শিল্প কারিগর এরশাদ উদ্দিন ও সমাজ কর্মী মোঃ ফরিদ উদ্দিন জানান,এক যুগ আগেও এ অঞ্চলের মানুষ ঢেঁকির মাধ্যমে ধান থেকে চিড়া, চালের গুঁড়া ও আটা তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তখন ঢেঁকির ধুপ-ধাপ শব্দে মুখোরিত ছিল চরাঞ্চলসহ আশপাশের গ্রামীণ জনপদগুলো। কিন্তু ঢেঁকির সেই ছন্দময় শব্দ এখন আর শোনা যায় না।
বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঢেঁকি ও ঢেঁকির শব্দ দুটোই যেন হারিয়ে গেছে। সেই সাথে ভাটা পড়েছে গ্রামীন জনপদে শ্রমজীবী মানুষের চিরচেনা নবান্ন উৎসবও। মূলত: জ্বালানী তেল কিংবা বিদ্যুৎ চালিত মেশিন দিয়ে ধান থেকে চাল ও চালের গুঁড়া তৈরীর কারণে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকির কদর আজ নেই বললেই চলে। ফলে চরাঞ্চলসহ আশপাশের গ্রাম গুলোতে ঘুরে এখন আর ঢেঁকির দেখা মিলছেনা।
এ ব্যাপারে গ্রামীণ ঐতিহ্যের বিলুপ্তপ্রায় ঢেঁকি প্রসঙ্গে স্থানীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের লেখক ও গবেষক হিসেবে সুপরিচিত কবি শাহ আলম বিল্লাল জানান, এক সময় হোসেনপুর উপজেলার প্রতিটি বাড়িতেই দু’চারটি করে কাঠের ঢেঁকি ছিল। তখন অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে ঢেঁকি ছাঁটা চাল ও চালের পিঠা তৈরি করে নবান্ন উৎসবে মেতে উঠতো কৃষক-কৃষাণিরা। সে সময়কার ঢেঁকিছাটা চালের পিঠার স্বাদ ও গন্ধ এখনও স্মৃতির পাতায় চির অম্লান হয়ে রয়েছে। তাই আজ নতুন প্রজন্মের কাছে ওই ঢেঁকি যেমন অচেনাই রয়ে গেছে, তেমনি এটির স্থান হয়েছে বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরে।