নিলফামারী জেলার ডোমার থানা এলাকা। সেখানকার বাসিন্দা জাকিরুল ইসলাম (২৫)। জাকিরুলের ডাক নাম বাচ্চা বাউ। এলাকায় যে তার খুব সুখ্যাতি আছে, বিষয়টি তেমন নয়। বাচ্চা বাউ পেশায় শ্রমিক হলেও তার বিরুদ্ধে ছোটখাটো চুরি এবং মাদক সেবন,মাদক বেচাকেনার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। বাচ্চা বাউয়ের নামে বিভিন্ন জনের থেকে অভিযোগ শুনতে শুনতে অভিযোগ পরিবারের সদস্যরাও তার ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত।
গত মে মাসের ৭ তারিখ সন্ধ্যা ৬ টা থেকে হঠাৎ করে বাচ্চা বাউ উধাও। কোথাও খোঁজ নেই তার। লোকমুখে বাচ্চা বাউয়ের পরিবার জানতে পারে, তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
যেহেতু বাচ্চা বাউয়ের বিরুদ্ধে মাদক মামলা আছে,তাই তার পরিবারও সে কথা বিশ্বাস করলো। তাই,পরিবারের সদস্যরাও বাচ্চা বাউকে খোঁজ করা থেকে বিরত থাকে।
কিন্তু ১০ মে এলাকার থানার বোড়াগাড়ী নালার খামারপাড়া এলাকায় পরিত্যক্ত জমির ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। কয়েক দিন আগের লাশ। মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে। কিন্তু এলাকাবাসীর সন্দেহ লাশটি বাচ্চা বাউয়ের। খবর পেয়ে বাচ্চা বাউয়ের পরিবারের সদস্যরা সেখানে যায়। লাশের পোশাক দেখে বাবা সেটিকে বাচ্চা বাউয়ের লাশ বলে শনাক্ত করেন। পরবর্তীতে লাশের সুরতহালের সময় প্যান্টের পকেটে একটি মামলার রেফারেন্সের কাগজ পাওয়া যায়। তাতে সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়, নিহত ব্যক্তি বাচ্চা বাউ।
এবার বাচ্চা বাউয়ের বাবা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করে থানায় হত্যা মামলা করেন। তদন্তে নামে নিলফামারী জেলা পুলিশ। পুলিশের তদন্তের শুরুতে বিভিন্ন সূত্র থেকে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিটি সূত্রকে বিশ্লেষণ করে ধরে ধরে এগুতে হয় পুলিশকে। বিষয়টি অনেকটা আকরিকের মধ্য থেকে সোনার টুকরা খোঁজার মতো। সঠিক পথে এগুতে পারলে রহস্য উন্মোচন করা যায়। কিন্তু সূত্র ভুল হলে আবারও গোড়া থেকে নতুন করে শুরু করতে হয়। রহস্য উন্মোচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোন সূত্র সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাবে, আর কোন সূত্র ভুল হবে, সেটি পৃথক করার সুযোগ খুবই কম থাকে।
বাচ্চা বাউয়ের ক্লু-লেস হত্যা রহস্য উন্মোচনেও একই সময়ে একাধিক সূত্র ধরে এগিয়েছে পুলিশ। সেখানে লাশটি পাওয়া গেছে, সেই জায়গাটি ভালো করে পর্যবেক্ষণে মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিলো, হয়তো অন্য কোথাও হত্যা করে লাশটি এখানে ফেলা হতে পারে। কিন্তু অন্য জায়গায় যদি হত্যা করাও হয়, তাহলে লাশটি এখানে এলো কীভাবে? কারা আনলো? কীসে করে আনলো? এবার ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথ বিশ্লেষণ শুরু করে পুলিশ। রাস্তার যে অবস্থা, তাতে বড়জোড় অটোরিকশা আসতে পারে। বড় গাড়ি দিয়ে এখানে আসা সম্ভব নয়।
ওই অনুমানের ভিত্তিতেই এবার এলাকার সকল অটোরিকশা চালক ও মালিকদের সাথে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশ। তাতে জানা যায়, এলাকার রাশেদ (১৯) নামের একজন অটোরিকশা চালান। তিনি গত ০৯ মে রাত সাড়ে ১০টায় পর্যন্ত অটোরিকশা নিয়ে বাইরে ছিলেন। ওই সময় সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলমান ছিলো। সন্ধ্যার পর তো দোকানপাট বন্ধ ছিলো। তাহলে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কী করেছে তা জানা প্রয়োজন। এজন্য রাশেদের খোঁজে অভিযানে নামে পুলিশ।
অনেক খোঁজাখুজির পর রাশেদের ভাড়ায়চালিত অটোরিকশাটি খুঁজে বের করে পুলিশ। অটোরিকশা মালিক মোঃ শফিকুল ইসলাম পুলিশের কাছে দাবি করেন,সাধারনত সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যে অটোরিকশা জমা দেওয়ার কথা থাকলেও ওইদিন রাতে দেরি করে অটোরিকশা ফেরত দেয় রাশেদ। এরপর থেকে রাশেদকে আর অটোরিকশা ভাড়া দেন না তিনি। এখন তিনি নিজেই সেটি চালান। কিন্তু রাশেদ এখন কোথায় আছে, তা তিনি জানেন না।
ওদিকে, বাচ্চা বাউকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, ওই খবরটি কীভাবে ছড়ালো, সেটিও খতিয়ে দেখতে শুরু করে পুলিশ। খবরের উৎস খুঁজতে খুঁজতে দেখা যায়, এলাকার নিখিল ও কমল এই সংবাদ মানুষের কাছে ছড়িয়েছেন। কিন্তু নিখিল ও কমল এই খবর কোথা থেকে পেলেন? বাচ্চা বাউ নিখোঁজের পর থেকে এমন গুজব ছড়ানোর সাথে খুনের কোনো যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। এবার নিখিল আর কমলের সন্ধানে নামে পুলিশ।
এদিকে, গোপণ সংবাদের ভিত্তিতে রাশেদকে গ্রপ্তার করে পুলিশ। শুরুতেই এই ঘটনার সাথে বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্ট থাকার কথা অস্বীকার করে রাশেদ। উল্টো নিরাপদ হওয়ার পরও পুলিশ তাকে হয়রানি করছে, এমন অভিযোগও তোলেন তিনি। কিন্তু,সহসা হাল ছাড়ে না পুলিশ। এবার ওইদিন রাতে কেন দেরি করে ফিরেছে, সেটি নিয়ে জেরার এক পর্যায়ে রাশেদ দাবি করেন, ওইদিন রাত আটটার দিকে এলাকার নিখিল,কমল ও রওশন জোর করে অটোরিকশাসহ তাকে ছোটরাউতা গ্রামের আদর্শ প্রাইমারি স্কুলের পিছনে নিয়ে যায়। এরপর তারা তিনজন মিলে স্কুলের পেছনের বেত ঝাড়ের মধ্য থেকে একটি লাশ এনে তার অটোরিকশাতে করে বোড়াগাড়ী নালার খামারপাড়া এলাকায় ফেলে দেয়। লাশ ফেলে দিয়ে অটোরিকশা মালিকের কাছে ফেতর দিতে গেলে দেখেন গাড়ি থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। তাই, মালিকের বাসার সামনে গিয়ে গাড়িটি পরিষ্কার করতে শুরু করেন। তখন মালিক মোঃ শফিকুল ইসলাম এসে গাড়িতে দুর্গন্ধের কারণ জানতে চান। তখন তাঁর কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন তিনি। এরপর থেকে গাড়ির মালিক চাবি নিয়ে যান এবং তাকে আর গাড়ি ভাড়া দেন না। কিন্তু নিখিল, কমল আর রওশন কোথায় আছে তা তিনি জানেন না।
রাশেদের কথার সূত্র ধরে এবার অটোরিকশার মালিককে রাশেদের মুখোমুখি করে পুলিশ। এবার,অটোরিকশা মালিক ওইরাতের ঘটনা স্বীকার করেন এবং তিনি যতটুকু রাশেদের থেকে শুনেছেন, স্বেচ্ছায় তা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দী দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এদিকে,পুলিশ জানতে পারে, নিখিল আর কমল এলাকা ছাড়া। রওশনেরও খবর নেই। কিন্তু এই হত্যা রহস্য উদঘাটনের জন্য ওই তিনজনকে যে খুবই প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় আছেন তারা? সেটি জানতে প্রযুক্তির সাথে যোগ করা হয় পুলিশের বুদ্ধিদীপ্ত তদন্ত কৌশল। অবশেষে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানা থেকে কমল আর রওশনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
গ্রেপ্তার কমল ও রওশন এই হত্যাকাণ্ডের আদ্যপান্ত পুলিশের কাছে খুলে বলে। কমল ও রওশনের ভাষ্য,গত ০৭ মে রাতে নিখিল ও তারা দুই জন ছোটরাউতা গ্রামের আদর্শ প্রাইমারি স্কুলের পিছনে ছিলেন। তখন বাচ্চা বাউ সেখানে যান। তখন নারীঘটিত বিষয় নিয়ে তাদের সাথে বাচ্চা বাউয়ের কথা কাটাকাটি হয়। তখন শ্বাসরোধ করে বাচ্চা বাউকে হত্যা করা হয়। ওইদিন হত্যার পর লাশে বেত ঝাড়ের ভেতরে গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। কিন্তু ওই এলাকায় মানুষের চলাচল আছে এবং তারা সেখানে নিয়মিত আড্ডা দেন। তাই লাশ পাওয়া গেলে মানুষ তাদের সন্দেহ করতে পারে। তাই পরিকল্পনা করে, ০৯ মে রাতে রাশেদের অটোরিকশাতে করে লাশটি সেখানে থেকে তুলে নিয়ে বোড়াগাড়ী নালার খামারপাড়া এলাকায় পরিত্যক্ত জমির ঝোপঝাড়ের মধ্যে ফেলে দেন।
কমল ও রওশন আরও দাবি করেন, মূলত এই হত্যাকাণ্ড থেকে তাদের দায় এড়াতে বাচ্চা বাউয়ের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধ হয়েছে, এমন ব্যক্তিদের বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় তারা লাশটি এনে ফেলে রাখেন, যাতে পুলিশের সন্দেহ ওইসব ব্যক্তিদের দিকে যায়। এ ছাড়াও লাশের পরনের প্যান্ট খুলে সেটিকে পরিস্কার করে লাশের পাশে রাখেন, যাতে এটা বোঝা যায়, আশপাশের কোনো বাড়িতে বাচ্চা বাউকে হত্যা করা হয়েছে। আর পুলিশ বাচ্চা বাউকে ধরে নিয়ে গেছে – ইচ্ছা করেই গুজব ছড়ান, যাতে পরিবার বাচ্চা বাউকে খোঁজাখুঁজি না করে কিংবা থানায় অভিযোগ না করে।
হত্যাকারীদের এতসব অপকৌশল কিছু সময়ের জন্য কাজে দিলেও বাংলাদেশ পুলিশের কৌশলী ও বুদ্ধিদীপ্ত তদন্তে তা ভেস্তে যায়। এ হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত নিখিলকে ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এভাবেই ঘটনার সাথে ২৩ দিন লেগে থেকে বাচ্চা বাউ হত্যা রহস্য উন্মোচন করে পুলিশ।
সর্বদাই জনগণের পাশে, বাংলাদেশ পুলিশ।
সৌজন্যে, PHQ media
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয়ঃ ৩৩ কাচারী রোড, ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবি সমিতির ৪ ও ৫ নং ভবনের বিপরীত পাশে।
ঢাকা কার্যালয়ঃ কে ৭৪/৫,কোরাতলী এআই ইউবি রোড খিলক্ষেত, ঢাকা, ১২২৯।
যোগাযোগঃ 01917925375 /01736554862 / 01721927699
প্রকাশক: মারুফ হোসেন কমল