১৫ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩১শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রচ্ছদ জাতীয়, ফিচার ❝ চা-পাতার গল্প! ইতিহাসের একটি নিষ্ঠুর রসিকতা! ❞
৬, জুলাই, ২০২০, ১:২৮ পূর্বাহ্ণ - প্রতিনিধি:

রাত শেষ হয়ে আসছে প্রায়। ধানমন্ডি-৩২ নম্বর রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্যাঙ্ক। যদিও গোলাবারুদ নেই সেটায়, তবে এই গোপন তথ্য দুই-তিনজন মানুষ ছাড়া আর কেউ জানে না।

১৫ই আগস্ট ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার রাতে পুরো ঢাকা শহরে দানবের মতো পায়চারি করেছে যন্ত্রদানবগুলো, ঘড়ঘড় শব্দে কাঁপন তুলেছিল রাজপথে। মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত দিয়ে ছিলেন ট্যাঙ্কগুলো, বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে। সেই ট্যাঙ্ক বহর ব্যবহার করেই তাঁর বন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করলো স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। আর এই হত্যার ঘটনায় ট্যাঙ্কের পাশাপাশি জড়িয়ে আছে আরেকটা জিনিসের নামও, সেটা চা-পাতা।

.
১৯৭৩ সালে আরব-ইজরাইল যুদ্ধ শুরু হলো, মুসলিম দেশগুলো নিজেদের সাধ্যমতো সেই যুদ্ধে সাহায্য করেছিল মিশরকে। বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া একটা দেশ, বিদ্ধ্বস্ত অবস্থা থেকে পুনর্গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রাণপন। মিশরকে সাহায্য করাটা বাংলাদেশের জন্যে তখন বিলাসিতার শামিল, তাছাড়া আফ্রিকান এই দেশটাকে কিভাবে সাহায্য করা যায়? তখন তো আমাদের নিজেদেরই চরম অভাব! তবে বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, আমাদের যা আছে সেটা দিয়েই তাদের সাহায্য করা যাক। আর তাই বাংলাদেশ থেকে উন্নত মানের এক লক্ষ পাউন্ড চা-পাতা পাঠানো হলো মিশরের সেনাদের জন্যে। যুদ্ধক্ষেত্রে কখনও কখনও চা আর সিগারেটের চাহিদা ভাত-রুটির চেয়েও ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায়। মিশরীয় সৈন্যদের সেই চাহিদাটা পূরণ করেছিল বাংলাদেশ থেকে পাঠানো চা-পাতা। ‘ব্যাটেল অফ সিনাই’ নামে পরিচিত সেই যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল মিশর, কিন্ত বাংলাদেশের এই বন্ধুবাৎসল্যের কথাটা ভোলেনি তাঁরা।
.
মিশর এইখানে থেমে গেলেই হতো। কিন্তু ইতিহাসের তখন অন্য ইচ্ছা। আরব-ইজরাইল যুদ্ধে মরুভুমিতে পড়ে ছিল ৩০টি “টি-৫৪ ট্যাঙ্ক”। বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে তখন ছিল মাত্র তিনটি ট্যাঙ্ক, যা ১৯৭১ সালে পরাজিত পাকিস্তান সেনাদের ফেলে যাওয়া। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশকে সেই ৩০টি “টি-৫৪ ট্যাঙ্ক” উপহার হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি জানতেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অস্ত্র ভান্ডার নেই বললেই চলে। চা-পাতার বদলে ট্যাঙ্ক দেয়াটা একটু বেশি আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ছিল হয়তো। আর এই ট্যাঙ্কগুলো দিয়ে বাংলাদেশ কি করবে, সেটা নিয়েও তখন প্রশ্ন উঠেছিল। আমাদের কি সত্যি কোনো ট্যাঙ্কের দরকার আছে? এসব ট্যাঙ্ক দিয়ে মিলিটারি ক্যু ছাড়া আর কিছু হয় না- এ ধরনের কথাও বলেছিলেন কেউ কেউ। কে জানতো, তাদের কথাই একদিন সত্যি হয়ে যাবে!
.
১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে ৩০টি ট্যাঙ্ক ৪০০ গোলা সহযোগে বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় মিশরের শুভেচ্ছা উপহার। আর সেগুলো গ্রহণ করে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে স্বয়ং মেজর ফারুক রহমান যিনি এক বছর পর ১৫ আগষ্ট সুচারু রুপে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও হত্যা পরবর্তী ঘটনা সামাল দেওয়ার কাজে ব্যবহার করে এই ট্যাঙ্কগুলো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিভ্রান্তি মূলক তথ্য প্রচার করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে ঘাতক দল এই ট্যাঙ্কের উপর উঠে উল্লাস করে। সেদিন ঢাকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক গুলি মানুষের মধ্যে আতংক ছড়িয়েছিল খুনীদের প্রত্যাশা মত। ঘাতক দল নির্লজ্জ্ব ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করলো তারই বন্ধুর দেয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে।

কিছু চা উপহারকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের মহানায়ক নিজেই তাঁর শত্রুর হাতে রশদ জুগিয়ে দিয়েছিলেন তার নিজেরই অজান্তে। এটা ইতিহাসের একটি নিষ্ঠুর রসিকতা!