তথ্য প্রতিদিন. কমঃ
১৯৪৭। ভারত ভাগ হয়ে গেছে। বিভক্ত বাংলা। কলকাতা হিন্দুস্থানে। ঢাকা পাকিস্তানে। কলকাতা ছেড়ে আসতে হবে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। বিদায় নিতে গেছেন রাজনীতির দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। মুজিব বললেন,
“ঢাকা যেতে হবে, শামসুল হক সাহেব খবর দিয়েছেন।”
“এসো”।
সোহরাওয়ার্দী এভাবেই বিদায় দিলেন রাজনীতির শিষ্য মুজিবকে। গুরু কী আর জানতেন একজন রাষ্ট্রনায়ক তার হবু রাজধানী স্থাপনের পথেই যেন পা বাড়ালেন! সেই পথে অবশ্য ছিলো অনেক চড়াই-উৎরাই। টুঙ্গিপাড়ার ‘খোকা’র জাতির জনক হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রামী পথ। এতে ছিলো বীরত্ব, বিদ্রোহ, কারাবন্দিত্ব আর বেদনা-গৌরবের নানা আখ্যান।
ভারতের কাছে কলকাতা হারানোর শোক নিয়ে শহর ঢাকায় আসার বিবরণ রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। তিনি লিখেছেন-
‘পূর্বে দু’একবার এসেছি বেড়াতে। পথ ঘাট ভাল করে চিনি না। আত্মীয়স্বজন যারা চাকরিজীবী, কে কোথায় আছেন, জানি না। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম।’
ঢাকা তথা তখনকার পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে এভাবেই পদার্পণ মুজিবের। যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ। এই শহরে কতো না পথ হেঁটেছেন মুজিব- দেশ মায়ের সেবায়, আর দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। পঞ্চাশের দশকে মুজিবের সেই যাত্রাপথ ‘আমার শহর’-এর কবি সৈয়দ শামসুল হকের চোখে এমন-
“এ শহরে শুনি না এখন
শেখ মুজিবের পায়ে কাবুলি চপ্পল
বাংলার বুকের গভীরে
শব্দ তুলে হেঁটে যাচ্ছে
আরমানীটোলা থেকে
কারকুন বাড়ির গলিতে…’
১৫০ মোগলটুলী থেকে ইতিহাসের নানা রাজপথ, গলিপথ শেষে এসে মিশেছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে। বাঙালির সেই শেষ ঠিকানা পেতে লেগেছে প্রায় দুই দশক। তবে মুজিব সেখানে আর কতোদিন। শাসকের কারাগারে বারবার নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তবু আপোষ করেননি বাংলার মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে। সংগ্রামের, ত্যাগের ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে আসে মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭১, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান। আত্মত্যাগ তখনও শেষ হয়নি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির মহত্তম নেতাকে বন্দি করে। নিয়ে যায় পাকিস্তানে। এটাই হয়ে যায় তুরুপের তাস। বাঙালির মুক্তি ও মুজিবের মুক্তি- মিশে যায় একই মোহনায়। দুটোর কোনোটিতেই একচুল ছাড় দিতে রাজী নয় গোটা বাংলাদেশ। প্রাণপণে যুদ্ধ। ৩০ লাখ মানুষের আত্মদানে লাল-সবুজের পতাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়। ১৯৭১, ১৬ ডিসেম্বর আসে বিজয়ের দিন।
কিন্তু বাংলাদেশ এসেছে, তার জনক এখনো আসেনি। সাতই মার্চে ছিলো মুক্তির দিশা। ছাব্বিশে মার্চে চূড়ান্ত ঘোষণা। সেই পথ ধরেই কলকাতার প্রবাসী সরকার, তার রাজধানী মুজিবনগর। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পতনে ঢাকা বাঙালির করতলে এলো। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেলো তার আসল রাজধানী। কিন্তু সেখানে তখনও ফেরেননি তার স্থপতি। ফেরেননি বাঙালি জাতির চোখের মণি শেখ মুজিব। যার নামে একতাবদ্ধ হয়ে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছে তিনি না ফিরে এলে স্বাধীনতা অর্থবহ হওয়া সম্ভবপর নয়।
পরাজিত পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সেটা ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২। করাচি-লন্ডন-দিল্লি। এই পথরেখায় ঢাকার পানে আসবেন বঙ্গবন্ধু। সেটা ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। সেই ঐতিহাসিক দিনে দৈনিক সংবাদ শিরোনাম দেয়-
‘বঙ্গবন্ধুর অপেক্ষায় ঢাকা নগরী’।
অবশেষে আসে সেই স্বর্ণালি সময়। তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দিকে একটি খোলা জিপে রওনা করেন। পুরো পথ লোকারণ্য বলে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। বিশাল জনসমুদ্রের সামনে ভাষণ দেন জাতির জনক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি যা বলেন, তার একাংশ এমন-
‘আজ আমি যখন এখানে নামছি আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষ কে আমি এত ভালোবাসি, যে জাত কে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’
সেই স্বাধীনতার মতোই অক্ষয় একটি দিন ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। টুঙ্গিপাড়ার মুক্ত খোকার বাড়ির ফেরার দিন।
©
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয়ঃ ৩৩ কাচারী রোড, ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবি সমিতির ৪ ও ৫ নং ভবনের বিপরীত পাশে।
ঢাকা কার্যালয়ঃ কে ৭৪/৫,কোরাতলী এআই ইউবি রোড খিলক্ষেত, ঢাকা, ১২২৯।
যোগাযোগঃ 01917925375 /01736554862 / 01721927699
প্রকাশক: মারুফ হোসেন কমল