চীফ রিপোর্টারঃ
গাজীপুর সদর হাসপাতাল থেকে হয়েছে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। নগর ও জেলায় বসবাসরত ৩০ লাখ মানুষের বেশিরভাগই এ হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল। বাড়ছে হাসপাতালের অবকাঠামো। কেনা হয়েছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। তবু এর চিকিৎসা সেবা নিয়ে রয়েছে অনেক অভিযোগ। একটু জটিল রোগী হলেই রেফার্ড করা হয় ঢাকার হাসপাতালে। কর্মকর্তাদের খামখেয়ালিতে বছরের পর বছর ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকে সরকারি অর্থে কেনা কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা আর চিকিৎসক-কর্মচারী ও যন্ত্রপাতির সংকটসহ নানা কারণে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীদের পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ, কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
শনিবার (৯নভেম্বর২০১৯), মানবজমিন-পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অনিয়ম-অব্যবস্থাপনাসহ নানা অভিযোগ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ সকল তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে হাসপাতালের স্টোর অফিসার রয়েছেন দুদকের তদন্তের জালে। তবে এককভাবে শুধু স্টোর অফিসারই নন, নানা অনিয়মে একটি চক্র জড়িত রয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে। যদিও হাসপাতালের পরিচালক বলছেন, জনবলের সংকট থাকায় হয়তো কাঙ্ক্ষিত সেবা কখনো কখনো দেয়া যাচ্ছে না, তবে কেনা-কাটা বা অন্যকোনোভাবে কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনা অনিয়ম বা দুর্নীতি নেই এই হাসপাতালে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালটি মেডিকেল কলেজে রূপান্তর করার পর রোগীর সংখ্যা বেড়েছে অনেক। মেডিকেল কলেজে উন্নীত হলেও কিছু সুবিধা ছাড়া অনেক কিছুই চলছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মতো। কাগজে কলমে ৫০০ শয্যা থাকলেও ওয়ার্ড রয়েছে অর্ধেকেরও কম। অনেক বেড রয়েছে বারান্দায়, অনির্ধারিত রুমে। বেশি রোগী হলে তাদের জায়গা হয় বারান্দায়, ফ্লোরে। অথচ খাবার সরবরাহ ও মালামাল কেনা-কাটা হয় ৫০০ শয্যার হাসপাতালের মতো। এই হাসপাতালে একটু জটিল রোগী আসলেই রেফার্ড করা হয় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি অপারেশন হয় না। ২৪ ঘণ্টা এক্সরে ও সিজার করানো হয়না। সব ধরনের প্যাথলজি টেস্ট করা হয় না। হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মতো রোগীদের ব্লাড, সুগার, বিলুবিরিন, ক্রিটেনিন, ইউরিয়া, সুগারসহ মাত্র ৬-৭ ধরনের প্যাথলজি করা হয়। যেখানে কমপক্ষে ২০ ধরনের প্যাথলজি টেস্ট হয়ে থাকে এই ধরনের অন্য হাসপাতালে। নামেমাত্র আলাদা শিশু ইউনিট থাকলেও শিশুদের আলাদা রেখে চিকিৎসা দেয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। স্কিনটেকের জন্যে ক্রায়োসার্জারি মেশিন নেই, মাত্র ৩-৪ লাখ টাকার একটি মেশিন কিনলেই সেবা পেতে পারে হাজার হাজার রোগী। ইএনটি বিভাগে সাধারণ টনসিল অপারেশন ছাড়া জটিল অপারেশন করার যন্ত্রপাতি নেই।
ডেন্টিস্ট বিভাগের অপারেশনাল কার্যক্রমও তেমন নেই। শুধু দুর্বল দাত তোলা আর পরামর্শ ছাড়া জটিল ধরনের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় না এই বিভাগে। আইসিইউ বিভাগের কিছু যন্ত্রপাতি কিনে ফেলে রাখা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে কেনা হচ্ছে না বিভাগটি চালু করার পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। গত অর্থবছরে এই বিভাগের আরো যন্ত্রপাতি কেনার সরকারি বরাদ্দের কয়েক কোটি ফেরত গেছে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায়। প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে সিটি স্ক্যান মেশিন কেনা আছে প্রায় ১ বছর ধরে। রহস্যজনক কারণে তা চালু করা হচ্ছে না। গত অর্থবছরে বিল পরিশোধ করে এখনো বুঝে নেয়া হয়নি অনেক কিছু। এমন অভিযোগও রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার দিকে এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মনযোগের চেয়ে রাজনীতি আর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি মনযোগ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। নিম্নমানের, কমদামের যন্ত্রপাতি ও মালামাল ক্রয় করে যোগসাজোশের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করার কথাও রয়েছে মুখে মুখে।
অভিযোগ রয়েছে, নার্স, টেকনেশিয়ান, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী ইত্যাদি ধরনের আউটসোসিংয়ের লোকবল নিয়োগ করে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। যেখানে তাদের বেতন দেয়ার কথা কমপক্ষে ১৬ হাজার, সেখানে চেকে সই নিয়েও কৌশল খাটিয়ে দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার টাকা। গত কয়েক বছর দেয়া হয়েছে আরো অনেক কম টাকা। একই ঠিকাদার শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও টঙ্গী জেনারেল হাসপাতাল দুটিতেই কাজ পাচ্ছে রহস্যজনক কারণে।
সিন্ডিকেট করে কেনা-কাটায় অনিয়ম ও টেন্ডার জালিয়াতি করে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়াসহ অভিযোগের অন্ত নেই স্টোর অফিসার নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। দুদকে তলব করে তদন্ত চলছে তার বিরুদ্ধে।
হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ও নানা অনিয়মের বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. আমীর হোসেন রাহাত বলেন, ডাক্তার, নার্স, টেকনেশিয়ান, আয়া, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী সব পর্যায়ে জনবল সংকট রয়েছে। আইসিইউ, সিসিউ বিভাগ চালুর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের চাহিদা মতো যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। আগের চেয়ে সেবার মান অনেক বেড়েছে। নির্মাণাধীন ১৫তলা বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হলে এবং জনবল সংকটের সমাধান হলে অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবেন সবাই। তবে তিনি হাসপাতালে পরিচালক হিসেবে যোগ দেয়ার পর কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি বা নিয়োগ বাণিজ্য হয়নি। নিয়মানুযায়ী টেন্ডারসহ সকল কার্যক্রম চলছে বলেও দাবি করেন তিনি। আউটসোসিংয়ে যারা কাজ করছে তাদের কেউ সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে কম পচ্ছে বলে কোনো অভিযোগও নেই তার কাছে। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন।
ছবি, সংগৃহীত