১৯শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৪ঠা ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রচ্ছদ জাতীয়, ফিচার রবি ঠাকুরের কলম চুরি হয়ে গেলো!
১৭, মে, ২০২৩, ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ - প্রতিনিধি:

তথ্য প্রতিদিন. কম:

সে আবার কী ! রবি ঠাকুরের ঘরে চোর ঢুকেছিলো ! অবাক হলেন ! তা তো হবেনই !
অত বড় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মধ্যে অন্য কোথাও নয় , শেষমেশ রবীন্দ্রনাথের ঘরে —
তাও আবার কলম !
হয়তো গল্পটি অনেকেই জানেন ! যারা জানেন না — তাঁদের জন্য আজকে সেই গল্পটি খোদ কলকাতা পুলিশের ডাইরী থেকে নেওয়া — রবীন্দ্রনাথের কলম চুরি। ঘটনাটি ১৯১৮ সালের ! যার পাঁচ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পান। যে ” ঝরনা কলম ” দিয়ে ঝরে পড়েছিলো রাশি রাশি কালজয়ী কাব্য—নাটক, সেটিই একদিন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তন্নতন্ন করেও হদিশ মিলল না।
আজ নয় এই নিয়েই বিষয়টি জানা যাক !

ভাবতে পারেন ,রবি ঠাকুর আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে — এই দৃশ্য নিশ্চিতভাবে ভারী বিড়ম্বনার হত আবালবৃদ্ধ বনিতার কাছে ! অথচ
সে যাত্রায় উকিল সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তৎপর হয়েছিলেন বলেই রবি ঠাকুর সাক্ষীর কাঠগড়ায় — এই বিড়ম্বনার দৃশ্য দেশের মানুষকে দেখতে হয়নি ৷ হ্যাঁ , ইনিই সেই সৌরীন্দ্রবাবু, যাঁর অন্য পরিচয় হলো — তিনি কিংবদন্তি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের পিতা৷

সেসময় পুলিশ কোর্ট ছিল লালবাজার চত্বরে —
যেখানে বর্তমানে ট্র্যাফিক বিভাগ আর রিজার্ভ ফোর্সের বিভিন্ন শাখার অফিস, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে সেই তিনতলা লালরঙা বাড়িটিতে। আদালতের কর্মকাণ্ডের আয়োজন প্রতিটি তলাতেই। একতলায় অফিস-কাছারি, করণিকদের বসার ব্যবস্থা। দোতলায় পরিপাটি বার – লাইব্রেরি এবং সেকেন্ড আর থার্ড প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট। পাবলিক প্রসিকিউটরের অফিসও। তিনতলায় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস ছাড়াও ফোর্থ আর ফিফ্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট। উকিলবাবুদের ব্যস্তসমস্ত আনাগোনায় আর মামলা-মোকদ্দমার সওয়াল-জবাবে দিনভর গমগম করতো পুলিশ কোর্ট। এবং মনে রাখবেন , এই সেই কোর্ট — যা অগ্নিযুগের বহু ঘাত-প্রতিঘাতের সাক্ষী !

রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ওকালতি করতেন এই পুলিশ কোর্টেই। ব্রিটিশ সরকারের চাকরি গ্রহণে ঘোর অনীহা ছিল ছাত্রজীবন থেকেই। সাহিত্যসাধনায় জীবন অতিবাহিত করবেন, এই ছিল অভীষ্ট। সে বাসনায় বাধা দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, এবং তাঁর অতীব স্নেহভাজন ছিলেন সৌরীন্দ্র। সদ্যযুবককে বুঝিয়েছিলেন কবি, ওকালতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে। আর সাহিত্যকে রাখতে নেশার অধিষ্ঠানে।

এবার মূল গল্পের আগে একটু রবীন্দ্রনাথের সময়ে ফিরে যাওয়া যাক — কলকাতার জোড়াসাঁকোয় !

সান্ধ্য সাহিত্যবাসর বসেছে রোজকার মতো আজও। রবীন্দ্রনাথের সদা-প্রশান্ত মুখমণ্ডলে আজ যেন একটু বিষণ্ণতার প্রলেপ। অন্যদিন প্রসন্ন মেজাজে তিনি ঠাট্টা-রসিকতা করেন, আজ মানুষটি কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ যেন। চিন্তিত হয়ে পড়েন বাকিরা। ব্যাপার কী !
কী হল ? অসুস্থ ? নাকি অন্য কারণ কোনো ?

এদিকে কবি সত্যেন্দ্রনাথ পড়ে শোনাচ্ছেন তাঁর নতুন লেখা। দ্বিজেন্দ্রনাথ বাগচী খাতা খুলে পাঠ করছেন কাব্য-সমালোচনা। খোলা গলায় গান ধরছেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভিন্ন ধারার গল্প সোৎসাহে শোনাচ্ছেন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু আসরের যিনি মধ্যমণি — তিনিই আজ কেমন যেন আনমনা। নিজের নতুন রচনা শোনান অন্যদিন, আজ দৃশ্যতই তিনি নিরুৎসাহ। আসরে উপস্থিত সদ্যযুবক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় — পেশায় পুলিশ কোর্টের উকিল হলেও নেশায় সাহিত্যানুরাগী, তিনিই দ্বিধা কাটিয়ে শেষে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন :

– কী হয়েছে গুরুদেব ? শরীর খারাপ ?

রবীন্দ্রনাথ ম্লান হাসেন উত্তরে , বলেন :
না … তবে তোমাদের রবি ঠাকুর আর তেমন লেখা লিখতে পারবেন না।

সবাই সমস্বরে হাঁ-হাঁ করে ওঠেন : কেন ? কী হল ?

– যে ঝর্ণা-কলমে তোমাদের রবি ঠাকুর লেখেন, সেটি হারিয়ে গিয়েছে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

– সে কী ! কোথায় গেল, ভালো করে খুঁজে দেখেছেন ?

– না দেখে কী আর বলছি …..

তাল কেটে যায় জোড়াসাঁকোর নিত্য সন্ধ্যার সেই আসরের। পছন্দের ‘ ঝর্ণা কলম ‘ বেপাত্তা হয়ে যাওয়ায় সাহিত্য-আলোচনায় সেদিন আর মন বসছে না রবীন্দ্রনাথের। গান-গল্প-কবিতার জমায়েতে একটা নান্দনিক আবহের প্রয়োজন হয় অথচ গৃহস্বামীর ঔদাসীন্যে সেটাই তো আজ অন্তর্হিত !
মন খারাপ রবীন্দ্রনাথের। তাঁর মুখে সবসময় একটাই কথা, ‘ আহা আমার সাধের ঝর্না কলম !’
গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ পাঠের মাঝে মাঝেই বারবার একই প্রসঙ্গ তুলে মন খারাপ করছেন তিনি।

মাসদুয়েক পরের দৃশ্য — এবার থানায় চলুন …..
আতর্নাদ ভেসে আসছে থানার ভিতর থেকে !

– আর কোনোদিন করবো না হুজুর, এই কান মুলছি।

থানার বড়বাবু শোনেন এবং পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড ধমক দেন বাজখাঁই গলায় … চোপ ! তুই তো যখনই ধরা পড়িস, তখনই একই কথা বলিস। কান মুলিস নাক মুলিস। স্বভাব যায় না ম’লে।
যার উদ্দেশ্যে তর্জনগর্জন, সেই চোর বাবাজীবন নিরুত্তর। কোমরে দড়ি, হাঁটু মুড়ে বসে মাটিতে। চোখমুখ দেখে অনুমান করা যায়, কিছুক্ষণ আগেই অকৃপণ চড়থাপ্পড় হজম করতে হয়েছে। না হজম করে উপায়ই বা কী ? এই বড়বাবুর জ্বালায় নিশ্চিন্তে ‘ইধার কা মাল উধার’ করার জো নেই। কোত্থেকে যে খবর পেয়ে যায় কে জানে !

মাসদুয়েক আগে এই অফিসারই ধরেছিলো বেলগাছিয়া থেকে। আর এবার ধরলেন টালায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে হানা দিয়ে বমালসমেত। গতবার জামিন পাওয়ার পর কিছুদিন ঘাপটি মেরে থেকে তবেই ফের কাজে নেমেছিলো। যাতে চট করে সন্দেহ না হয় পুলিশের। দিব্যি চলছিল মাঝরাতে সিঁদ কেটে আর ভরদুপুরে ফাঁকতালে এর-ওর বাড়ি থেকে জিনিসপত্র হাতিয়ে। শেষ পর্যন্ত ঠিক ধরে ফেললো ! …..পুলিশের তো শুনি বদলির চাকরি — এই বড়বাবুর বদলি হবে না ? কতদিন হয়েছে এই থানায় ? এসবই চোর – এর ভাবনা ! ভাবনায় ছেদ পড়ে পিঠে লাঠির ঘায়ে।

– আর মারবেন না হুজুর …

মারের আর কী দেখেছিস এখনো ? কোনটা কোন বাড়ি থেকে চুরি করেছিস বল শিগগির, নাহলে পিটিয়ে চামড়া তুলে দেবো।

চোরের আস্তানা থেকে উদ্ধার হয়েছে সামগ্রী হরেকরকম । কাপড়চোপড় – গয়নাগাঁটি – ঘড়ি
বাসনকোসন – সোনার বোতাম – কলমদোয়াত — থানার টেবিলে ছড়ানো রয়েছে চোরাই মাল।

– হুজুর ..এটা কলুটোলার কাছে দোতলা বাড়ি থেকে… ওইটা ফলপট্টির পাশে যে ডাক্তারবাবু বসেন, তাঁর চেম্বার থেকে… আর এইটা…
বড়বাবু নোট করতে থাকেন গম্ভীর মুখে।
তালিকা শেষ হলে হাঁক দেন অধস্তন অফিসারকে …

– গাড়ি লাগাতে বলো, বেরবো। এ ব্যাটাকেও তোলো গাড়িতে। এই … ওঠ !

ঘাড় ধরে চোরকে গাড়িতে তোলেন থানার জমাদার। বড়বাবু জাঁকিয়ে বসেন সামনের সিটে। ড্রাইভার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। উত্তর আসে দ্রুত।

– প্রথমে কলুটোলা, তারপর ফলপট্টি, তারপর …

জোড়াসাঁকো থানার বড়বাবুর গাড়ি এলাকায় চক্কর দিচ্ছে চোরসমেত। কোন বাড়ি থেকে কী কী জিনিস হাতিয়েছে, কাঁচুমাঁচু মুখে দেখিয়ে দিচ্ছে চোর। কলুটোলা-ফলপট্টি ঘুরে গাড়ি ঢুকলো একটি গলিতে।

– এখানে কোন বাড়ি ? বল !

বড়বাবুর দাপটে জবুথবু চোর চটপট জবাব দেয়।

– আর একটু এগিয়ে …

– কতটা এগিয়ে ?

– সামনেই .. এই তো … এই বাড়িটা হুজুর …

গাড়ি থামল চোরের দেখানো বাড়ির সামনে। এবং বাড়িটি দেখেই যথারীতি বজ্রাহত বড়বাবু ! এ কী ! এই বাড়িতেও ! নিজেকে সামলে নিতে লাগলো মিনিটখানেক, তারপর চোরকে এই মারেন কী সেই মারেন ! ঠিক বলছিস ? এই বাড়ি ?

– হ্যাঁ হুজুর .. এই বাড়ি। কলমটা এখান থেকেই চুরি করেছিলাম একদিন দুপুরবেলায়। বাড়িতে তখন লোকজন বিশেষ ছিল না।

– হতচ্ছাড়া ! আর বাড়ি পেলি না চুরি করার ? আশেপাশে তো আরও অনেক বাড়ি আছে, সেখানেও তো লোকজন থাকে না দুপুরের দিকে।
– সব ছেড়ে তোর এই বাড়িতেই নজর পড়ল হতভাগা ! করলি তো করলি, এখানেই !

ক্রুদ্ধ বড়বাবুর প্রবল চপেটাঘাতে চোখে সর্ষেফুল দেখে চোর। বড়বাবু এত রেগে গেলো কেন হঠাৎ ? কিসে আলাদা এই বাড়ি ? কোনো রাজা-মহারাজা থাকে নাকি ? হোমরাচোমরা কেউ ? চুরির সময় কি বাছবিচার করা যায় ? কে থাকে এখানে ?
……………………………………………………………………….
সেদিন সকালে, দশটার দিকে, রবীন্দ্রনাথ পায়চারি করছেন জোড়াসাঁকোর দোতলার বারান্দায়, হঠাৎ উপস্থিত জোড়াসাঁকো থানার সেই ইনস্পেক্টর।
সঙ্গে কোমরে দড়ি বাঁধা সেই চোর – মহোদয় !
থানার বড়বাবু দেখা করতে চাইছেন শুনে নিচে নেমে এলেন একটু বিস্ময় নিয়েই — হঠাৎ পুলিশ কেন ?

পুলিশ ইন্সপেক্টর বললেন , ” গুরুদেব, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু বাধ্য হয়েই আসতে হল। এটি একটি দাগী আসামি। চুরির কেসে ধরা পড়েছে। তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা জিনিসের মধ্যে সোনাগয়না, জামাকাপড়, বাসনপত্র, বোতাম, বই ছাড়াও আছে একটি ঝর্ণা কলম। চোরটি বলছে কলমটা নাকি সে চুরি করেছে এই বাড়ি থেকে। ”

উদ্ধার হওয়া সেই ‘ ঝর্ণা-কলম ‘ – টি বড়বাবু দেখান রবীন্দ্রনাথকে। কবি শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে প্রগলভ হয়ে বলে ওঠেন — ” এই তো আমার সাধের কলম !
এ কলমেই তো আমি লিখি। ক’দিন হল, হারিয়েছে – কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। কোথায় পেলেন ?
কে নিয়েছিল ? ”

এরপর রবীন্দ্রনাথের সংক্ষিপ্ত বয়ান নিজের নোটবইয়ে লিপিবদ্ধ ক’রে বেরনোর উদ্যোগ করেন বড়বাবু। কবিগুরু জিজ্ঞাসা না করে পারেন না —
‘ আমার কলম কবে পাবো ? ‘

এক্ষুনি কলম ফেরত দেওয়ার ব্যপারে অপারগ — সেটাই বড়বাবু জানিয়ে দেন সবিনয়ে :
‘কোর্টে কলমের মকদ্দমা হবে – সে মকদ্দমা হয়ে গেলেই আপনি আপনার কলম পাবেন। ‘

রবীন্দ্রনাথকে সামান্য বিমর্ষ দেখায় — সাধে কী বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে …।

বড়বাবু আইনের ব্যাখ্যা দেন, কলমটি ‘ Stolen and recovered ‘ – প্রপার্টি। আদালতে চোরাই মাল আগে আইনি পদ্ধতিতে শনাক্ত হবে,তারপরই কলম ফিরিয়ে দেওয়া হবে বিচারকের লিখিত নির্দেশে।
সব শুনে কবি আর কথা বাড়ান না। আইনের কচকচিতে কোনোকালেই বিশেষ রুচি নেই তাঁর।বেশ,আইনি প্রক্রিয়ার সমাপন পর্যন্ত না হয় অপেক্ষাই করবেন। কলমটা অন্তত পাওয়া গেছে, ভেবে নিশ্চিন্ত বোধ করেন।

কিন্তু সে নিশ্চিন্ত বেশিদিন থাকতে পারলে তো ! জোড়াসাঁকো থানার জমাদার কয়েকদিন পর সকালে ঠাকুরবাড়িতে এসে রবীন্দ্রনাথের হাতে ধরিয়ে গেলেন
‘ আদালতের সমন ‘ !
কলম চুরির মামলায় — সাক্ষ্য দিতে হাজিরা দিতে হবে — লালবাজার প্রাঙ্গণে অবস্থিত আদালতে। সমন দেখেই অবসন্নের মতো ইজিচেয়ারে বসে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ । তিনি আগে খুশি হয়েছিলেন কলমটা উদ্ধার হয়েছে ও সেটা ফেরত পাবেন জেনে , কিন্তু দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি এই কলমের জন্য শেষমেষ আদালতের সমন আসবে তাঁর কাছে !

সেই মুহূর্তে গোপালকে ডেকে তৎক্ষণাৎ আদালতে যেতে বললেন — “এখনই কাছারিতে যাও সৌরীনের কাছে। গিয়ে তাঁকে বলবে এ তলব বন্ধ করা চাই। না হলে তাঁদের রবি ঠাকুর হার্টফেল হয়ে মারা যাবে। বন্ধ করতে না পারেন যদি, তাহলে বলো, খাট কিনে দলবল নিয়ে যেন তিনি এ বাড়ীতে আসেন। ”

এদিকে সৌরীন্দ্রমোহন সেদিন নিয়মমাফিক কোর্টে। হঠাৎ দেখলেন, গোপালবাবু প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছেন — হাতে ধরা একটি কাগজ।
গোপাল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বাড়ির কর্মচারী।
ব্যাঙ্কে যাওয়া-আসা, ছোটখাটো ফাইফরমাস খাটা, এসব করতেন নিষ্ঠাভরে। বিশ্বাসভাজন ছিলেন কবির। সৌরীন্দ্র অবাক হলেন, এই মাঝদুপুরে গোপালবাবু হঠাৎ কোর্টে ? কবির কিছু হল না তো ?

” আপনার কাছেই এসেছি। কবির ভারী বিপদ। এই দেখুন ! ” — হাঁফাতে হাঁফাতে হাতে ধরা কাগজটি সৌরীন্দ্রকে ধরিয়ে দেন গোপাল। কাগজটিতে এক ঝলক চোখ বুলিয়েই সৌরীন্দ্র বাকরুদ্ধ !

রবীন্দ্রনাথের নামে আদালতের সমন ! থার্ড প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুজ্জামান খাঁ সাহেবের সই রয়েছে, আছে কাছারির শীলমোহরও। সারবস্তু, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৯ ধারায় দায়ের হওয়া চুরির মামলায় সাক্ষী দিতে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অমুক তারিখে আদালতে হাজিরা দেওয়ার হুকুম।

– কিন্তু কী চুরি গেছে গুরুদেবের ? ব্যাপারটা কী ?
একটু ধাতস্থ হয়ে প্রশ্ন করেন সৌরীন্দ্র। ‘ব্যাপারটা’ পরিষ্কার হয় গোপালের উত্তরে।

– কবির ঝর্ণা-কলম। হারিয়ে গিয়েছিল মাসদুয়েক আগে।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো জানি। উনি বলেছিলেন আমাদের।

– হারায়নি আসলে, চুরি হয়েছিল। চোর ধরা পড়েছে কয়েকদিন আগে।

– তারপর ?

গোপালের মুখে বাকি বৃত্তান্ত শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন সৌরীন্দ্রমোহন। ছুটলেন ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে, শোনালেন সমন-কাহিনী আনিস সাহেবকে। যিনি নিজে সাহিত্যরসিক এবং আপাদমস্তক রবীন্দ্রভক্ত। সব শুনে বেশ কয়েক মিনিটের জন্য আনিস বাকরহিত। ডেকে পাঠালেন কোর্ট ইনস্পেকটর শরৎকুমার ঘোষকে। এবং যিনি হাজির হতেই ক্ষোভ উগরে দিলেন সরোষে : ” এ আপনি কী করেছেন শরৎবাবু ? কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই আপনার ? ”

শরৎবাবু হতভম্ব। কী এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করলেন ! আনিস সাহেব ঠান্ডা মাথার মানুষ, সুভদ্র প্রকৃতির। তিনি এমন রেগে আগুন কেন ?

– কী করলাম স্যার ?

সমনটি এবার শরৎবাবুর দিকে প্রায় ছুঁড়েই মারেন আনিস সাহেব।

– কী করেছেন নিজেই দেখুন ! দেখুন দেখুন !
তুচ্ছ একটা কলম-চুরির মামলায় সাক্ষী দিতে রবীন্দ্রনাথকে তলব করেছেন এই পুলিশ কোর্টে। এতে তাঁর কতখানি অপমান হয়েছে, কোনো ধারণা আছে আপনার ?

– কী করব স্যার ? অফিসারের রিপোর্টে রবীন্দ্রনাথের ছাড়া আর কারোর নাম না থাকলে আমি কী করব ? তিনি ওই কলম শনাক্ত করেছেন নিজে। আমি তো নিরুপায়। তাঁকেই তো শনাক্ত করতে হবে আদালতে। তাছাড়া স্যার, আইন তো সকলের জন্যই সমান।
সে রবীন্দ্রনাথই হন আর …

‘ থামুন ! ‘ বেজায় রেগে গিয়ে শরৎবাবুকে থামিয়ে দেন আনিস সাহেব — ” ‘ সকলে ‘ আর রবীন্দ্রনাথ এক হলেন ? আর আইন অত দেখাবেন না। আমি আপনার থেকে আইন বেশি বই কম জানি না। আইন মানুষের জন্য। রবীন্দ্রনাথ একজনই হন। তাঁর জন্য আইনের একটু ব্যতিক্রম ঘটলে মহাপাপ হবে না কিছু। সৌরীন্দ্রবাবু, যে ভদ্রলোক ঠাকুরবাড়ী থেকে এসেছেন সমন নিয়ে, তিনি নিশ্চয়ই ওই কলমটি অনেকবার দেখেছেন। চিনতে পারবেন নিশ্চয়ই ? ”

সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন সৌরীন্দ্রমোহন।
আনিস সাহেব নির্দেশ জারি করেন তৎক্ষণাৎ।

– ব্যস, তা হলে মিটেই গেল। শরৎবাবু, গুরুদেবের নামে যে সমন গিয়েছিল, সেটি আমি বাতিল করলাম। রবীন্দ্রনাথ যাঁকে পাঠিয়েছেন, তাঁর নামে নতুন সমন জারি করুন। তিনি এসে সাক্ষ্য দেবেন মামলায়, কলম শনাক্ত করবেন।

শরৎবাবু বেরিয়ে গেলেন হুকুম তামিলে আর আনিস সাহেব সখেদে হাত চেপে ধরলেন সৌরীন্দ্রের।

– না জেনে আমি মহাপাতকের মতো কাজ করে ফেলেছি মিস্টার মুখার্জী। এককাঁড়ি কাগজ নিয়ে এসে মুখের সামনে ধরে কাছারির লোক, সইয়ের জন্য। রুটিন কাগজে সই করে দিই রুটিনমাফিক। কার নামে সমন, সে দেখার অবসর থাকে না সবসময়। আমার হয়ে দয়া করে রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন। বলবেন, তাঁকে প্রণাম জানিয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, তিনি যেন প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।

বাকি ঘটনা উদ্ধৃত করা যাক , সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘উকিলের ডায়েরি’ বইটি থেকে। যেখানে রয়েছে ঘটনাক্রমের সরস বিবরণী :

“ ব্যাপারের নিষ্পত্তি তখনি হয়ে গেল। গোপালবাবু চলে গেলেন এবং কোর্টের পর আমি গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে রিপোর্ট দিলে, হেসে তিনি বললেন, তোমার জন্য আজ রবি ঠাকুর অকালমৃত্যু থেকে বেঁচে গেল। আমাদের দেশে কথা আছে, রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি সঃ বান্ধবঃ। তুমি রাজদ্বারে থেকে বান্ধবতার যে পরিচয় দিলে, তার জন্য প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করি , তোমার জয় হোক !”

কলকাতা পুলিশের শতাব্দীবিস্তৃত ইতিহাসে লালবাজার প্রাঙ্গণ কৃতার্থ হয়েছে বহু মনীষী ও বিপ্লবীদের পদধূলিতে। যাঁদের অধিকাংশেরই আগমন অগ্নিযুগের দিনগুলিতে — হয় কারাবরণ করে, নয় কোনো মামলায় আসামী বা সাক্ষী হিসাবে — আদালত-হাজিরায়।
লালবাজারে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পদার্পণ ঘটলে ধন্য হয়ে যেত কলকাতা পুলিশের সদর দফতর, সংশয়ের অবকাশ নেই কোনো। তবে তলিয়ে ভাবলে মনে হয়, লালবাজারে কবির সম্ভাব্য উপস্থিতির যে প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছিল, তা যে চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি, ভালোই হয়েছিল একপ্রকার। নোবেলজয়ী বিশ্ববন্দিত কবি সাক্ষীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান নিজের চুরি হয়ে যাওয়া কলম শনাক্ত করতে — সে ভারী বিড়ম্বনার দৃশ্য হতো ! ভাগ্যিস হয়নি। ফুটবলের পরিভাষায় বললে যাকে বলে — ” গোললাইন সেভ !”

নাহলে , লালবাজারে রবীন্দ্রনাথ !
এক অন্য ইতিহাস হয়ে যেতো !

কার্টেসীঃ
অচেনা লালবাজার / সুপ্রতিম সরকার
কলকাতা পুলিশ / রবিশঙ্কর পাল