চীফ রিপোর্টার
– ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা খাদ্য গুদামে ৩২৮ টন ৯৮০ কেজি চাল পায়নি ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি। সরকারের অর্থনৈতিক মূল্য অনুযায়ী উল্লেখিত চালের দাম ১ কোটি ৭০ লাখ ৭২ হাজার ২৮২ টাকা। গুদাম পরিমাপের সময় পাওয়া যায়নি ৮৯ হাজার ৭০০ টাকা মূল্যের ৩০ কেজির ১৪৯৫টি ও ৩০ হাজার ৪০০ টাকা মূল্যের ৫০ কেজির ৩৮০টি খালি বস্তা। বিষয়টি জানাজানি হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রেবেকা সুলতানা রুবী কঠোর গোপনীয়তায় মুক্তাগাছা থানায় মামলা দায়ের করেন।
গোপন থাকলেও মামলা দায়েরের খবর ছড়িয়ে পড়ে। মামলায় আসামি করা হয়েছে পালিয়ে যাওয়া খাদ্য পরিদর্শক ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাকিল আহমেদকে। অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করে সরকারি সম্পদ আত্মসাত করার ৪০৯ ধারায় দায়ের করা মামলাটি দুদক তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। আলোচিত মামলাটি আপাতত মুক্তাগাছা শহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মোঃ শফিকুল ইসলাম তদন্ত করছেন। গত মাসের শেষ দিকে ধরা পড়ে মুক্তাগাছা খাদ্য গুদামের চাল আত্মসাতের ঘটনা। ২০১৯ সালেও ঘটে একই ঘটনা। ৪৫০ টন চাল কেলেঙ্কারী নিয়ে তোলপাড় হয়েছিলো। নিম্নমানের পুরাতন চাল কিনে মজুদ, মিল মালিকদের সাথে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তখন ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া হয়। ওই ঘটনার বিচার না হওয়ায় এবং দুর্নীতিবাজদের লাগাম না টানার কারণে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে বলে সুশীল সমাজের অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। গুদামে চালের মজুদ না দেখেই বিল প্রদান করে সরকারি টাকা আত্মসাতের সহযোগিতা করা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রেবেকা সুলতানা রুবী পর্যন্ত বহাল তবিয়তে ছিলেন। কর্তৃপক্ষ তাকে দিয়েই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করান। মুক্তাগাছার এ ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না গুদামের অন্যান্য স্টাফ, ময়মনসিংহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের কারিগরী খাদ্য পরিদর্শক, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, ময়মনসিংহের খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা । তাদের বিরুদ্ধেও পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা যায়, মুক্তাগাছা থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে ত্রুটি রয়েছে। মামলা রেকর্ডের আগে ২ বার এজাহার পাল্টানো হয়। চাল ও খালি বস্তা আত্মসাতের তারিখ দেখানো হয়েছে ০৯-০৩-২০২১ থেকে ১৭-১০-২০২৩ তারিখ সন্ধ্যার মধ্যে যেকোনো সময়। গুদামের মজুদ অনুযায়ী ২ মাস আগে শেষ হওয়া বোরো চাল আত্মসাত করা হয়। আত্মসাতের ঘটনা দেখানো হয় ২ বছর ৭ মাসের যেকোনো সময়। অথচ গুদামে পুরাতন কোনো চাল মজুদ ছিলো না। শাকিলের যোগদান থেকে পালিয়ে যাওয়ার তারিখ পর্যন্ত আত্মসাত দেখানো হাস্যকর এবং আইনের ফাঁক-ফোকর তৈরী করা ছাড়া আর কিছুই নয়। অপরদিকে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি অদৃশ্য কারণে কঠোর গোপনীয়তায় দীর্ঘ ২৭ দিন গুদামের চাল পরিমাপ করে। রহস্যজনক কারণে তারা কর্তৃপক্ষের দোহাই দিয়ে সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলেন। রিপোর্ট জমা দেওয়ার পরও কেউ মুখ খুলছেন না। কঠোর গোপনীয়তার কারণে নানান প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়
গৌরীপুরের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম কমিটির প্রধান ছিলেন। ত্রিশালের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইলিয়াস আহমেদ, ফুলপুরের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আতিকুর রহমান, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসের উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (কারিগরী) নুসরাত বিনতে আনিস ও খাদ্য পরিদর্শক মোঃ শিব্বির আহাম্মদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। তদন্ত কমিটির প্রধানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। ২৪-০৮-২০২০ থেকে ০২-১০-২০২২ তারিখ পর্যন্ত তিনি মুক্তাগাছা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্নীতিবাজ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাকিল আহমেদ ১ বছর ৭ মাস তার অধীনে চাকরি করেন। তখনই তিনি অতিমাত্রায় দুর্নীতিতে জড়ান।
সূত্র জানায়, মুক্তাগাছা খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাকিল আহমেদ চাবি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ১৪ দিনের মাথায় ২৫ অক্টোবর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রোমানা রিয়াজ গুদামের তালা ভেঙে দিলে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি চাল পরিমাপ শুরু করে। ২৭ দিনের মাথায় রবিবার গুদামের চাল পরিমাপ ও গুণগত মান যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়। আত্মসাতের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার প্রাণান্ত অপচেষ্টা চালানো হয়। সূত্র মতে, ২ নম্বর গুদামের ১২টি খামাল ও পেসেজে (করিডোর) থাকা চালের পরিমাপ ৭ নভেম্বর শেষ হয়। পরদিন শুরু হয় ১ নম্বর গুদামের চাল পরিমাপ। রবিবার ১ নম্বর গুদামের ১২টি খামাল ও পেসেজের (করিডোর) চাল পরিমাপের কাজ শেষ হয়েছে। সোমবার নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে গুদামের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কমিটি কঠোর গোপনীয়তায় সোমবার রাতে কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। কয়েক টন নিম্নমানের চাল পাওয়া গেলেও কমিটি রিপোর্টে উল্লেখ করেনি। ২ গুদামের ২৪টি খামালের মধ্যে কয়েকটি খামালের মাঝামাঝি খাড়া করে বস্তা রেখে মজুদ সঠিক থাকার অভিনব কায়দা করা হয়েছিলো। মজুদ অনুযায়ী ২ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার মুক্তাগাছা খাদ্য গুদামে ৩ হাজার ৩৭৯ টন চাল থাকার কথা ছিলো। ২ মাস আগে শেষ হওয়া বোরো সংগ্রহ মৌসুমে মুক্তাগাছা খাদ্য গুদামে ১৫ হাজার ৪৭২.৮৩০ টন চাল সংগ্রহ করা হয়। মূল বরাদ্দ ১৩ হাজার ৮৪৭.৯১০ ও অতিরিক্ত বরাদ্দ ১ হাজার ৬২৪.৯২০ টন। ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত বরাদ্দের ৩০০ টন চাল সরবরাহ না নিয়েই মিল মালিক ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের যোগসাজশে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাকিল বিল উত্তোলন করান। একই সময় অন্য যেকোনো মিলারের কাছ থেকে ২৯ টন চাল সরবরাহ না নিয়েই বিল উত্তোলন করানো হয়।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও ময়মনসিংহের আলোচিত মুক্তাগাছা খাদ্য গুদামে ৪৫০ টন চাল কেলেঙ্কারীর ঘটনা ঘটে। মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া শুরু হলে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্ণেলিউস চিসিম ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেন। ১৮০ টন নিম্নমানের চাল কিনে মজুদ, অতিরিক্ত বরাদ্দের কথা বলে মিল মালিকদের কাছ থেকে ২০০ টন চাল সংগ্রহ ও কম দামে ডিও’র ১২০ টন চাল কিনে মজুদ পুর্ণ করেন। প্রতারণার শিকার মিলারদের চালের বিল না দেওয়ায় সালিস