তথ্য প্রতিদিন. কম:
ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রিপল মার্ডারের মুলঘাতক আলী হোসেনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। মামলা দায়েরের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডিবি পুলিশ গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত আলী হোসেন নিহত আমেনা খাতুনের স্বামী ও তার নিহত দুই ছেলের পিতা। ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পদোন্নতি প্রাপ্ত পুলিশ সুপার) শামীম হোসেন বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের হলরুমে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। আলী হোসেন আদালতে স্ত্রী ও দুই ছেলে হত্যার দায় স্বীকার করেছ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরো বলেন, গত ২১ মে দুপুরে ত্রিশালের রামপুরের কাকচর নয়াপাড়ায় জমির আইলের পাশে মাটিতে পুতে রাখাবস্থায় ত্রিশাল থানা পুলিশ ৩ টি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। এর মাঝে একটি মহিলার অর্ধগলিত লাশ সনাক্ত হলেও পরিচয় সনাক্ত করা যায়নি। থানা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশের অন্যান্য বিশেষায়িত ইউনিট পিবিআই, সিআইডি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রযুক্তির সহায়তায় লাশের পরিচয় সনাক্তের চেষ্টা করেন কিন্তু লাশগুলো অর্ধগলিত হওয়ায় এবং শিশু বাচ্চা দুইটির লাশ মস্তক বিহীন হওয়ায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং এর মাধ্যমে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলেই লাশগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতসহ আনুষাঙ্গিক অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্ন করে ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করে পুলিশ।
পরে নিহতের পড়নের কাপড়-চোপড় এবং অন্যন্যা বৈশিষ্ট দেখে পরিচয় সনাক্ত হয়। সনাক্তকৃত পরিচয় থেকে জানা যায় তিনটি লাশ যথাক্রমে কাকচরের নয়াপাড়ার আলী হোসেনের স্ত্রী আমেনা খাতুন, তার চার বছরের ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিকি ও ২ বছর ৬ মাস বয়সী ছেলে আনাছ।
নিহতদের পরিবারের বরাত তিনি আরো বলেন, নিহত আমেনার পরিবার আমেনা খাতুন কিংবা তার স্বামী আলী হোসেনের সাথে গত কয়েকদিন ধরে মোবাইলে যোগাযোগ করতে না পেরে আলী হোসেনের নিজ বাড়ীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, আলী হোসেন ঢাকার উদ্দেশ্যে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে গত শুক্রবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। তার পর থেকে আলী হোসেন পলাতক।
এ ঘটনায় নিহত আমেনার মা হাসিনা খাতুন তার মেয়ের জামাই আলী হোসেনসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে ত্রিশাল থানায় মামলা নং-২৩, তারিখ-২২/০৫/২০২৪ দায়ের করেন।
মামলা দায়েরের পর পুলিশ সুপারের নির্দেশে ডিবি পুলিশের একটি চৌকশ টিম ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও আসামী গ্রেফতারে মাঠে নামেন। তথ্য প্রযুক্তি ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে মামলা দায়েরের ২৪ ঘন্টার মধ্যে হত্যাকান্ডের মূল হোতা নিহত আমেনার স্বামী আলী হোসেনকে বুধবার রাতে গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত আলী হোসেন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা প্রদান করেন। সে দিনমজুরের কাজ করত। তার কোন জমিজমা ছিল না। অভাবের সংসারে স্ত্রী আমেনা খাতুন এবং দুই ছেলে ছিল। তিনি চাচার দেওয়া জমিতে অনেক দিন ধরে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে। সারা বছর অভাব অনটন লেগেই থাকত। ঠিকমত তার সংসার চালাতে পারত না। তার স্ত্রী নিহত আমেনার নামে এনজিও থেকে টাকা তুলত। বেশ কিছুদিন পূর্বে সে এনজিও থেকে ১লাখ ৭০ হাজার টাকা ঋণ নেয়। সেই টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় তাকে এবং তার স্ত্রীকে অপমান করা হত। প্রায়ই তার ছেলে ও বৌ না খেয়ে দিন কাটাত। ঋণের বোঝা, মানুষের অপমান, সংসারের অভাব অনটন থেকে মুক্তি পেতে ২/৩ মাস আগে আলী হোসেন সিদ্ধান্ত নেয় তার স্ত্রী ও সন্তানদ্বয়কে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করবে। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আলী হোসেন গত ১৭ মে শুক্রবার রাত অনুমান ২ টারদিকে তার স্ত্রী ও সন্তান ঘরে ঘুমিয়ে থাকাবস্থায় প্রথমে স্ত্রী আমেনা খাতুনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে। স্ত্রী আমেনা বিছানা থেকে নেমে ঘরের মেঝেতে গিয়ে বসলে আলী হোসেন তার গায়ে থাকা ওড়না গলায় পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে দুই ছেলে ঘুমিয়ে থাকাবস্থায় স্ত্রীর গলা থেকে ওড়না খুলে নিয়ে প্রথমে ছোট ছেলে আনাছের গলায় ওড়না পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং পরে বড় ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিকের গলায় ওড়নার বাকী অংশ পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে ঘাতক আলী হোসেন স্ত্রী নিথর দেহ কাঁধে তুলে নিয়ে ঘরের পিছন দিয়ে জঙ্গলে রেখে পরপরই দুই ছেলেকেও কোলে করে ঐ জঙ্গলে রাখে। পরে মাটিতে গর্ত করে স্ত্রী ও তার ২ ছেলের লাশ মাটিতে পুতে রাখে। পাষন্ড ঘতাক লাশ তিনটি পুতে রেখে ঘরে ঘুমিয়ে সকাল ১০ টারদিকে হরিরামপুর এলাকায় চলে যায় এবং বিকালে বাড়ীতে ফিরে এসে মালামাল নিয়ে গফরগাঁও মশাখালী ষ্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠে প্রথমে কমলাপুর রেল ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা করে। ডিবির হাতে গ্রেফতারের আগে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য সে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে ছিল। আলী হোসেন ত্রিশাল থানায় ২০১২ সালে ধর্ষণ এবং শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনায় একটি মামলায় ৫ বছর কারাভোগ করে ২০১৭ সালে আগস্ট মাসে জামিনে মুক্তি লাভ করেন। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন। ডিবির ওসি ফারুক হোসেন, এসআই শাহ মিনহাজ উদ্দিন, এসআই রেজাউল আমীন বর্ষন, এসআই পরিমল চন্দ্র সরকার (পিপিএম), এএসআই জাহাঙ্গীর, রুহুল আমিন এই অভিযান পরিচালনা করেন। ডিবির ওসি ফারুক হোসেন জানান, ঘাতক আলী হোসেনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বিচারক মনিরুজ্জামানের আদালতে ঘাতক আলী হোসেন স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়ে ট্রিপল হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।