আজিসঃ
পৌষ সংক্রান্তির শেষ বিকেলে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ীয়া উপজেলার লীপুরের বড়ই আটায় তালুক-পরগনার সীমানায় হবে হুমগুটি খেলা। পৌষ মাসের শেষ দিনকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় পুহুরা। প্রায় আড়াইশত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই খেলা বছরে একবার একই স্থানে হয়। পিতলের তৈরি প্রায় ৩০ কেজি ওজনের গুটি আয়ত্ব করে নিজ গ্রামে নিয়ে গুম করা পর্যন্ত চলে এই খেলা। এই খেলাকে কেন্দ্র করে ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ঐ অঞ্চল সমুহের গ্রামগুলোতে চলে অন্যরকম উৎসাহ উদ্দীপনা আমেজ। গোটা অঞ্চলের পরিবেশ হয়ে উঠে উৎসবমুখর। ফুলবাড়ীয়ার লীপুর ও দশ মাইলের মাঝামাঝি বড়ই আটা বন্দে (খোলা মাঠে) খেলার কেন্দ্রস্থল। বিকেল তিনটার দিকে খেলা শুরু হয়। সকাল থেকে ফুলবাড়ীয়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ত্রিশাল, মুক্তাগাছাম সদর উপজেলার লোকজন আসতে থাকে লীপুর বড়ই আটা বন্দে। ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদর থেকে সাড়ে ৫ কিলোমিটার উত্তরে লীপুরের বড়ই আটা বন্দ বা এই খেলার কেন্দ্রস্থল। খেলা শুরুর আগে ময়মনসিংহ-ফুলবাড়ীয়া সড়কের অদূরে ভাটিপাড়া, বালাশ্বর, তেলিগ্রামের সংযোগস্থল নতুন সড়কে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশীকান্তের সাথে ত্রিশালের বৈলরের হেম চন্দ্র রায় জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়।
র
জমিদার আমলের শুরু থেকেই তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ৯ ও ১০শতাংশে, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের ভূখন্ডে দুই নীতির প্রতিবাদে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে ওঠে বলে জনশ্র“তি রয়েছে। জমির পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসার জন্য লীপর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে (যেখানে শুরু তালুক পরগনার সীমানা) সেখানে এই গুটি খেলার আয়োজন করে। গুটি খেলার শর্ত ছিল, গুটিটি যে দিকে যাবে তা হবে তালুক, পরাজিত অংশের নাম হবে পরগনা। জমিদার আমলের গুটি খেলায় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয়। আজও তালুক পরগনার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে ব্রিটিশ আমলে জমিদারি খেলার গোরাপত্তন। আমন ধান কাটা শেষে প্রজাদের শক্তি পরীার জন্য জমিদারদের এই পাতানো খেলা চলছে বছরের পর বছর ধরে। এর পর থেকে প্রতি বছর এ খেলা বিরতিহীন চলে আসছে। আগামীকাল মঙ্গলবার ১৪ জানুয়ারী বাংলা ৩০ শে পৌষ জমজমাট হুমগুটি খেলাকে কেন্দ্র করে ফুলবাড়ীয়ায় মেতে উঠবে লাধিক মানুষের মিলন মেলা। ৩০ কেজি ওজনের পিতলের গুটি ঢাক ঢোলের তালে তালে নেচে গেয়ে তালুক পরগনার সীমানায় নিয়ে আসে এলাকাবাসী। প্রতি বছর পৌষের শেষ বিকেলের এ খেলাকে ঘিরে অতি প্রাচীনকাল থেকেই লীপুর, বড়ই আটা, ভাটিপাড়া বালাশ্বর, শুভরিয়া, কালীবাজাইল, তেলিগ্রাম, সারুটিয়া, গড়বাজাইল, বাসনা, দেওখোলা, কুকরাইল, বরুকা,বৈদ্যবাড়ি, কুশমাইল, জোরবাড়িয়া, আন্দারিয়াপাড়া, ফুলবাড়ীয়া পৌর সদর, চৌদার, দাসবাড়ী, কাতলাসেন, দাপুনিয়া সহ আশে পাশের ২০/২৫টি গ্রামে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পড়ে নতুন জামা কাপড়, শতাধিক গরু-ছাগল জবাই হয় গ্রামের বিভিন্ন স্থানে। গুটি খেলা এক নজর দেখার জন্য দূরদূরান্তের আত্মীয় স্বজনরাও ভীড় জমায় এ গ্রামে তাদের আত্বীয়দের বাড়িতেু। এ খেলায় থাকে না কোন রেফারী বা আমপায়ার। আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কোন প্রকার বাহিনীর প্রয়োজন হয় না। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে খেলা। কোন কোন বছর পরদিন পর্যন্ত খেলা চলার রেকর্ডও রয়েছে। রাত যতই হতে থাকে খেলোয়ারদের মাঝে শক্তির মহড়া ততই বাড়তে থাকে। একেক এলাকার একেকটি নিশানা থাকে। ঐ নিশানা দেখে বুঝা যায় কারা কার পরে লোক। গুটিটি কোন দিকে যাচ্ছে তা মুলত চিহিৃত করা হয় নিশানা দেখেই। নিজেদের দখলে নিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয় খেলায়। এভাবে গুটিটি গুম না হওয়া পর্যন্ত চলে এ খেলা। তবে ব্যতিক্রমী হলো একটি মাত্রই গুটি। যা প্রতি বছর লক্সিপুর অঞ্চল থেকে পৌষের শেষ বিকালে খেলার জন্য ছাড়া হয়। যারা বিজয়ী হন তারা ঐ গুটিটি নিজেদের কাছে রেখে দেন বছরব্যাপী। পরে তাদের কাছ থেকে আবারো গুটিটি লপিুর এলাকার লোকজন সংগ্রহ করে নতুন বছর আবারো ছাড়ছেন। এভাবেই আড়াইশথ বছর ধরে চলে আসছে এই হুমগুটি খেলা।